আর্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন প্রতিরোধ এবং আর্য বিরোধীদের নিরাপদ ভূমিতে পরিণত হয়। বহিরাগত সেনরা ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করলে বখতিয়ার খলজির বিজয় অভিযান জনগণকে মুক্তি দেয়। ১২০৪ সালে মাত্র ১৭জন অগ্রবর্তী অশ্ববাহিনী নিয়ে বখতিয়ার খলজি বঙ্গ বিজয়, ১২২১-২৭ ইওয়াজ খলজির দিল্লির বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৩৩৮ ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ কর্তৃক বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা, ১৩৪২ শামছুদ্দীন ইলিয়াছ শাহের জাতীয়তাবোধের উদ্বোধন, ১৩৫৯ ফিরোজ শাহ তুঘলকের দ্বিতীয় বাংলা অভিযান, ১৬১০ সালে সুবাদার ইসলাম খা কর্তৃক ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর ১৬৬৬ শায়েস্তা খানের চট্টগ্রাম অধিকার ও ইসলামাবাদ নামকরণ, ১৭১৭ মুর্শিদকুলী খান বংলার সুবাদার নিযুক্ত, ১৭৪০ আলীবুর্দী খান বাংলার সুবাদার নিযুক্ত। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজুদ্দৌলার অবিস্মরণীয় স্বদেশ প্রেমের চেতনা, ১৭৬০-১৮০০ ফকির মজনুশাহের ইংরোজ বিদ্রোহ, ১৮১৮-৬২ হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তাঁর ছেলে দুদুমিয়া কর্তৃক ফরায়েজী আন্দোলন, ১৮২১-৩১ অকুতভয় বীর তিতুমীরের সাহসিকতা, ১৮৫৭ হাবিলদার রজব আলী কর্তৃক সিপাহী বিপ্লব, ১৮৬০ নীল বিদ্রোহ, ১৯২০ খেলাফত আন্দোলন, ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তি, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ জাতি তার স্বকীয়তাকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে বারবার। অন্যদিকে এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল হযরত শাহ জালাল (রঃ), শাহ মাখদুম, পীর খান জাহান আলী, হাজী শরীয়তুল্লাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, মাওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী, মুন্সী মেহেরুল্লাহ প্রমূখ সাধক ও সংস্কারকদের পুণ্য পদচারণায় এ জাতি মূখরিত ও উজ্জীবিত হয়েছে। সর্বশেষে পাকিস্তান সৃষ্টির অগ্র সেনানী এদেশ বাসীরাই পাকিস্তানী অন্যায় অবিচারের নিকট মাথা নত না করে লক্ষ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে হাজার বছরের কাঙ্খিত স্বপ্ন তুমি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। (মাহবুব রব চৌধুরী, গবেষক ও সমাজচিন্তক)
দেশের আপামর মানুষের সংগ্রাম সাহসিকাত বীরত্ব গাঁথা মণীষীদের কীর্তিকর্ম মুসলিম সাধকদের পদচারণার উপর ভিত্তি করে এই জনপদে গড়ে উঠেছে স্বতন্ত্র অনন্য এক সাংস্কৃতি। যা এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের শেকড়ের সাথ সম্পৃক্ত হয়ে আছে। একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল কোন আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে নির্মিত হয় না। বরং হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের জীবনবোধ ইতিহাস ঐতিহ্য চেতনা ধর্ম বোধের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এমনি সুদীর্ঘকালের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতি। আমাদের অর্থাৎ মুসলমানদের সংস্কৃতিতে একটি অংশ জুড়ে আছে ইসলামী গান। যতটুকু জানা যায় নবাবী আমল মোঘল আমলে সাংস্কৃতিক চর্চার ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। ফলে জাতি হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি ইসলামী গানের বিশাল ভান্ডার। এই ইসলামী গানের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে আমাদের স্বপ্ন সাধনা এবং সংগ্রামের সুর ও কথা মালা।
গবেষক ডঃ এনামূল হক মুসলিম বাংলা সাহিত্য' নামক গ্রন্থ লিখেছেন সংগীত শাস্ত্রে মুসলমানদের খ্যাতি চির প্রসিদ্ধ। ভারতীয় সংগীতেও মুসলমানদের অবদান অনেক। মধ্য যুগের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ সংগীত সম্পর্কীত পৃথকে সর্বপ্রথম রাগরাগিনীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। এথেকে প্রমাণিত হয় ইসলামী গানে মুসলমানদের অবদান দীর্ঘকালের। মধ্য যুগ জুড়ে গীত হওয়া মুর্শিদী, মারফতি, বাউল গানের চেতনা পরোক্ষভাবে হলেও মুসলিম ঐতিহ্যবোধকে সমৃদ্ধ করেছে।
আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান / কোথা সে মুসলমান।
আল্লাহকে যে পাইতে চায় / হযরতকে ভালবেসে।
আমি যদি আরব হতাম / মদিনারই পথ।
ইসলামেরই সওদালয়ে / এল নবীন সওদাগর।
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই / যেন সকাল সন্ধ্যা মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।
নজরুলের পথ ধরে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন মুসলিম ঐতিহ্যের আরেক ধারক বাহক ফররুখ আহমদ। ফররুখ আহমদকে বলা হয়। নজরুলদলের উত্তরসূরী। তার রচিত গানের কয়েকটি।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের / এনেছে ফেনা,
তুমি জাগলে না / তবু তুমি জাগলে না।
ও আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা / খোদার সেরা দান।
জিহাদের এই ঝান্ডা আমরা / চিরদিন উঁচু রাখব।
ফররুখ আহমদের সমসাময়িক আরেকজন গীতিকার হলেন গোলাম মোস্তফা। তার রচিত হামদ, নাত ইসলামী গান এদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতিতে এখনো গীত হয়ে ফেরে।
আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী ইসলামী গানের দেওলিয়াত্ব শুরু হয়। এসময় আদর্শচ্যুতির বিভ্রাপ্ত চোৱাবালীতে অনেকেই পতিত হয়েছে। এই বন্ধ্যাত্বকে ঘুছাতে স্বতন্ত্র সংগীত শৈলী চমৎকার সাংস্কৃতিক দিক নির্দেশনা নিয়ে হাজির হন মতিউর রহমান মল্লিক আশির দশকে। বাদ্যযন্ত্রহীন ইসলামী গান তিনি শুরু করেন। তিনি ও তার দল গেয়ে উঠলেন :
সেই সংগ্রামী মানুষের সারিত / আমাকেও রাখিও রহমান।
হিজল বনে পালিয়ে গেল পাখি।
তুমি রহমান / তুমি মেহেরবান।
ওগো নবী দোজাহানের সবার সেরা তুমি।
হলদে ডানার সেই পাখিটা
আজ খুব পড়ছে মনে মাকে।
স্বাধীনতার পূর্বাপর অনেকে আধুনিক বাংলা সংগীতে বা গানে নজরুলের ইসলামী গানের গুনাবলীকে সামনে রেখে গান সংযোজন করেণ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আবু জাফর, আব্দুল লতিফ, রফিকুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, খান আতাউর রহমান, গাজী মাযহারুল আনোয়ার, নজরুল ইসলাম বাবু, লোকমান ফকির, আজাদ রহমান প্রমুখ।
বর্তমান তথাকথিত মর্ডান চিন্তা চেতনায় নবীন গীতিকারেরা প্রেম স্বর্বস কামোদীপ্ত চটুল গান রচনায় পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। যার ফলে আমাদের বাংলা গান থেকে নির্বাসিত হয়েছেন পূর্বোক্ত গীতিকাররা। এতে বন্ধ হয়ে যায় শিল্প সমৃদ্ধ মননশীল গান রচনার পথ। তার স্থান দখল করে নেয় নোংরামী আর অশ্লীলতা। কালের স্রোতধারা পেরিয়ে আজ বাংলা গান প্রেম বিরহের পাগলের প্রলাপে পরিণত হয়েছে। যার কয়েকটি উদাহরণ না দিলেই নয়।
আমার মাটির গাছে লাউ ধরেছে / লাউযে বড় সোহাগী।
আস যদি বাশঁ বাগানে / আবার হবে দেখা।
মন দিলে মন পাবে/ দেহ দিলে দেহ/সবি হবে অগোচরে/ জানবে নাতো কেহ।
বন্ধু যখন বউ লইয়া / আমার বাড়ীর সামনে দিয়া / রঙ্গ কইরা হাইট্যা যায় / বুকটা ফাইট্যা যায়।
আজ রাতে তোমাকে যেতে দেবনা/ তুল তুলে গনি আছে/ আছে বিছানা,
এই হলো আমাদের বর্তমান আধুনিক বাংলা গানের বানী। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দেওলিয়াত্ব ঘোছোতে ইসলামী সংস্কৃতির বিকল্প নেই। নজরুল, ফররুখ, গোলাম মোস্তফা ইসলামী গানের যে ধারার উদ্বোধন করেছিলেন তা এখন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমিরুল মোমিনিন মানিক, আবু জাফর, সাইফুল্লাহ মানছুর, মশিউর রহমান, সাহাবুদ্দিন প্রমূখ। তারা এগিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনার নয়া দিগন্তে। ঈমান ও বিশ্বাসের দ্বারা সংগীত আঙ্গিনা পূর্ণ হোক এই আশাবাদ আমাদের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন