সৌন্দর্যের লীলাভূমি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি:
ব্রিটিশ আমলে ইসলামি শিক্ষার উচ্চতর গবেষণার জন্য বিশিষ্ট ইসলামি শিক্ষানুরাগীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮০ সালে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয় । আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় কোন ফল না আশায় ১৮৩৭ সালে সরকারি আদেশে ১৮৫৮ সালে কলিকাতা আলিয়া মাদরাসা বন্দের সুপারিশ করা হয়। তখন মুসলমানদের আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এরই প্রেক্ষিতে উপমহাদেশে মুসলিম মনীষী ও শিক্ষাবিদগণ একটি স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন করতে থাকে। ১৯১২ সালে ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদসহ ঢাকায় একটি আবাসিক 'মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়' প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। ১৯১৩ সালে বগুড়া জেলায় মওলানা আকরম খাঁ ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীগণসহ আঞ্জমান ওলামায়ে বাঙ্গালা আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করে।
পরে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামিক স্টাডিজ একটি বিভাগসহ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে বহু কমিশন গঠিত হয় কিন্তু ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ১৯৭৪ সালে মাওলানা ভাসানী সন্তোষে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেসরকারিভাবে একটি বিশ্বিবিদ্যালয় স্থাপন করেন।
১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টি গুরুত্ব অনুধাবন করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৭৭ সালে ড. এম এ বারীকে সভাপতি করে 'দ্যা ইসলামিক ইউনিভার্সিটি স্কিম' ৭৭ গঠন করেন। যার সুপারিশের আলোকে ১৯৭৯ সালে ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ-এর মাঝামাঝি শান্তিডাঙ্গা-দুলালপুরে ১৭৫ একর জমির উপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। তবে, বর্তমানে আরও (১০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে)।
জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ১৯৮৩ সালে এক আদেশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে মূল ক্যাম্পাস থেকে ঢাকার গাজীপুরের বোর্ড বাজারে স্থানান্তর করেন। বোর্ড বাজারে ৫০ একর জমির উপর একাডেমিক ভবণ ও আবাসিক হলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পর ১৯৮৫-৮৬ শিক্ষাবর্ষে ধর্মতত্ত্ব ও ইসলামী শিক্ষা অনুষদেন অধিন আল-কুরআন ওয়া উলুমুল কুরআন ও উলুমুল তাওহীদ ওয়াদ দাওয়াহ বিভাগ এবং মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের অধিন ব্যবস্থাপনা ও হিসাব বিজ্ঞান- এ চারটি বিভাগ ৮ জন শিক্ষক ও ৩০০ জন ছাত্র নিয়ে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু বৃহত্তর কুষ্টিয়া-যশোর অঞ্চলের জনগন বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরে বিরুদ্ধে ব্যাপক গনঅন্দোলন গড়ে তোলে ফলে, তৎকালীন সরকার তার রাজনৈতিক ভরাডুবির ভয়ে এবং এতদঞ্চলের মানুষের আন্দোলনের মূখে অপর এক আদেশে ১৯৯০ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরের বোর্ড বাজার হতে গড়াই নদীর অনতিদূরে কুষ্টিয়া থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী শান্তি ডাঙ্গা দুলালপুরের মূল ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৯০-৯১ শিক্ষাবর্ষ হতে প্রথমবারের মতো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর গ্রোত্র জাতি এবং ছাত্রী ভর্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এক নজরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : আয়তন-১৭৫ একর, অনুষদ- ৮টি, বিভাগ-৩৪, আবাসিক হল-৮টি। (ছাত্রদের (ছাত্রদের ৫টি, ছাত্রীদের ৩টি) নির্মাণাধীন ২টি। ছাত্র সংখ্যা-১৫,৪১৭ জন, বিদেশী শিক্ষার্থী-৩৯ জন, শিক্ষক-৪১২ জন, কর্মকর্তা-৪২৫ জন,কর্মচারী-৩৯৯ জন। প্রতিষ্ঠান- ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (IIER)।
ডিগ্রিসমূহ : অনার্সসহ স্নাতক- বিএ, বিটিআইএস, বিবিএ, বিএসএস, এল এল বি, বিএসসি, বি ফার্ম, বি ইঞ্জিনিয়ারিং। মাস্টার্স- এমএ, এমটিআইএস, এমবিএ, এমএসএস, এল এল এম, এমএসসি, এম ফার্ম, এম ইঞ্জিনিয়ারিং। উচ্চতর ডিগ্রি- এমফিল, পিএইচডি।
শিক্ষার মাধ্যম
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হল- বাংলা, ইংরেজি ও আরবী। থিওলজি বিভাগের ছাত্রছাত্রীগণ বাংলা, ইংরেজি ও আরবী ভাষায় উত্তরপত্র লিখতে পারেন। থিওলজি অনুষদ ব্যতিত অন্যান্য অনুষদের ছাত্রছাত্রীগণ বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে উত্তরপত্র লিখতে পারেন।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে আধুনিক বিশ্বের সাথে যোগ্য, মেধাবী, সৎ, নিষ্ঠা ও কর্মঠ মানব সম্পদ হিসাবে নিজেকে গড়ে তুলুন। অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে গড়ে তুলুন দুর্গ।
অনুষদ ও বিভাগসমূহ
থিওলজি অনুষদ- আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ, আল হাদিস এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ ও দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ। কলা অনুষদ- আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাংলা বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং চারুকলা বিভাগ। সমাজ বিজ্ঞান অনুষদ- অর্থনীতি বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ফোকলোর বিভাগ, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও সমাজকল্যাণ বিভাগ। আইন অনুষদ- আইন বিভাগ, আল ফিকহ এন্ড লিগাল স্টাডিজ বিভাগ এবং আইন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিভাগ। ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ- হিসাব বিজ্ঞান এবং তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, মার্কেটিং বিভাগ, ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। বিজ্ঞান অনুষদ- গণিত বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ, ভুগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ- ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, এপ্লাইড কেমিস্ট্রি এন্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইনফরমেশন এন্ড কমিনিউকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বায়োমেডিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। জিব বিজ্ঞান অনুষদ-ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, বায়োটেকনোলজি এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং ফার্মেসি বিভাগ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পঞ্চম স্থান। আসন সংখ্যা ২২৭৫টি।
সুযোগ সবিধা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সামাজিক, সেচ্ছাসেবী, সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রাংঙ্কনসহ নানা ধরনের সংগঠন রয়েছে। যাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেকে মেলে ধরা যায়। প্রধান কয়েকটি সংগঠন যেমন-বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, ডিবেটিং সোসাইটি, হল কেন্দ্রিক ডিবেট সোসাইটি, সাংবাদিক সংগঠন, থিয়েটার, আবৃত্তি, লেখক ফোরামসহ প্রায় ১৮টি সংগঠন। খেলাধুলার মধ্যে ক্রিকেট, ফুটবল, বলিবল, হ্যান্ডবল,বাস্ককেট বল,ব্যাডমিন্টন খেলার মাঠসহ সরঞ্জামাধী। আবাসিক হলের মধ্যে ছাত্রদের সাদ্দাম হোসন হল, শহীদ জিয়াউর রহমান হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, লালন শাহ হল,শেখ রাসেল হল। ছাত্রীদের বেগম খালেদা জিয়া হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুনেসা হল ও শেখ হাসিনা হল। (বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হল ও অফিস ও বিভাগসমূহে ইন্টারনেট তথা ওয়ােইফাই সুবিধা রয়েছে)। শারীরিক শিক্ষাি ইনিস্টিটিউট ছাত্রছাত্রীদের জন্য বহুমূখী বিনোদনমূলক কার্যক্রমের আয়োজন করে থাকে। এছাড়া আইসিটি সেলের মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি পরিষেবা দেওয়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়তা ও অংশীধারিত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। পরিবহন সুবিধাদীর ক্ষেত্রে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিবহন সেবা চালু আছে। এছাড়াও বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য সুসজ্জিত থাকার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদেন্য পরিবহন, ডিমনেসিয়াম, টিউশন ফি মওকুফ ও বৃত্তি প্রদানের সুবিধা রয়েছে।
শেষকথা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর স্বপ্নের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আজ এক মহিরূহ আকার ধারণ করেছে। জ্ঞান পিপাসু মানুষের মনে আলোকের দিশারী হয়ে উঠেছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যাল। আধুনিক শিক্ষার সাথে ইসলামী শিক্ষার সমন্বয় সাধনের মাধ্যেমে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মূল ধারায় ফিরে আসুক এটাই দেশ জাতির প্রত্যাশা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন