জ্বীন ও মানুষের মধ্যে বহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে যেমন নারী পুরুষ আছে, বিবাহ-শাদী, সন্তান উৎপাদন, জন্ম-মৃত্যু প্রথা আছে, এগুলো জ্বীনদের মধ্যে ও আছে। মানুষের যেমন পানাহার আরাম, আয়েশ, তন্দ্রা নিন্দ্রার প্রয়োজন আছে, জ্বীনদের ও প্রয়োজন আছে। মানুষ যেমন রিপুর প্রভাবে সৎ ও অসৎ হয়, জ্বীনদের একই অবস্থা। মানুষের প্রতি যেমন আল্লাহর হুকম আহকাম, ইবাদত-বান্দেগী, আদেশ নিষধ পালন করার নির্দেশ রয়েছেন জ্বীনদের প্রতি ও তেমনি রয়েছে। মানুষের মধ্যে যেমন কিছু লোক আল্লাহর নির্দেশ পুরোপুরি ভাবে পালন করে আবার কিছু লোক বিরোধীতা করে জ্বীনদের ও ঠিক একই অবস্থা। পরকালে মানুষের যেমন পাপ পূণ্যের হিসাব হবে এবং বিচারের ফলাফল হিসাবে কেউ বেহেশত লাভ করবে আবার কেউ দোযখে যাবে, জ্বীনদের পাপ পূণ্যের বিচার অনুসারে বেহেস্ত দোযখ নির্ধারিত হবে।
জ্বীন কয়েক ধরনের আছে তার মধ্যে ইবলিস অন্যতম। সে হযরত আদম আ: কে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল। তাই আল্লাহ তার উপর অভিশাপ ও লানত দিয়েছেন। কেয়ামত পর্যন্ত সে অভিশপ্ত।খানজাব সে নামাজরত মানুষের মনে নানা রকম চিন্তা ঢুকিয়ে নামাজ থেকে অমনোযোগী ও উদাসীন করে তুলে। ওলহান এক প্রকার শয়তান জ্বীন, যারা মানুষকে ওযুর সময় ওয়াসওয়াসা দেয়। ক্বারীন এক প্রকার জ্বীন। ক্বারিন অর্থ হচ্ছে সংগী, প্রত্যেক মানুষের সাথেই শয়তান জ্বীন লেগে থাকে, মানুষের অন্তরে খারাপ চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়ে পাপ কাজ করতে উৎসাহিত করে এবং গইলান হলো যাদুকর জ্বীন এরা মানুষের পথ বদলে দেয়।
জ্বীনদের বাসস্থান হলো নির্জন ও পরিত্যাক্ত স্থান। হাদিস থেকে জানা যায় জ্বীনেরা নোংরা, ময়লা, পায়খানা, পস্রাব খানা ও দুর্ন্ধময় জায়গায় জ্বীনদের অবাধ বিচরণ। জায়েদ বিন আরকাম বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসুল (সঃ) বলেছেন, পায়খানা এবং প্রস্রাব করার জায়গায় জ্বীন এবং শয়তানরা অবাধে বিচরণ করে। তোমাদের মধ্যে যেই এই স্থানগুলোতে যাবে, সে যেন বলে- ‘আমি আল্লাহর কাছে পুরুষ এবং মহিলা শয়তানের থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। জ্বীনদের খাদ্য হিসাবে যা খায় তাহলো মানুষের ফেলে দেয়া খাবাব, হাড়, গোবর খায়।হাদীসে বলা হয়েছে, আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল(সঃ) বলেছেন- হাড় এবং গোবর জ্বীনদের খাবার। (বুখারী, ৩৫৭১)
মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা, আর জ্বীন সৃষ্টি হয়েছে আগুন দ্বারা। মানুষ সশরীরি দৃশ্যমান জীব, আর জ্বিন অদৃশ্যমান জীব। মানুষের অবস্থান চলা-ফেরা, কথাবার্তা, কাজ কর্ম সব কিছুই জ্বীনেরা দেখে, অথচ জ্বীনদের মানুষ দেখতে পায় না। মানুষ নিজেদের চেহারার পরিবর্তন করে অন্য আকৃতি ধারণ করতে পারে না। পক্ষান্তরে, জ্বীনেরা একমাত্র হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর আকৃতি ছাড়া অন্য যে কোন মানুষের ও পশু পাখির আকৃতি ধারণ করতে পারে। জ্বীন জাতি অসাধারণ ভাবে মানুষের নানা উপকার করতে পারে আবার ক্ষতিও করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালার সমর্থন ছাড়া মানুষ জ্বীনদের পক্ষে বিপক্ষে তেমন কিছু করার সুযোগ ও সামর্থ্য রাখে না।
আগেই বলা হয়েছে জ্বিন জাতির আদি পিতা আবুল জ্বিন থেকে বংশ বিস্তার লাভ করে তারা সারা দুনিয়াতে ছড়িছে পড়েছে। কিন্তু তেজক্রিয় অগ্নি দ্বারা সৃষ্ট বলে তাদের স্বভাবে, কাজে-কর্মে, উগ্রতা, রূঢ়তা, বদমেজাজ লক্ষ করা যায়। ফলে ন্যায়-অন্যায়, রীতি-নীতির, সৎ-অসৎ কাজের তোয়াক্কা করে না। যখন যা ইচ্ছে করতে শুরু করে দেয়। তাদের এ অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ তাদের উপর কিছু আদেশ নিষেধ বাক্য বাধকতা আরোপ করেন। রীতি-নীতির অনুসরণে চলার নির্দেশ দিয়ে একজন বাদশা ও পয়গম্বর প্রেরণ করলেন।
তিনি জ্বীনদেরকে আল্লাহর আদেশ নিষেধ জানিয়ে সৎপথ অবলম্বনের প্রেরণা ও উদ্দীপনা দান করতে লাগলেন। কিছুদিন তারা তাদের বাদশা ও পয়গম্বরের প্রদর্শিত সৎপথে চললো। কিন্তু ক্রমে তাদের মধ্যে আবার অসৎ প্রবৃত্তি চাঙ্গা হয়ে উঠলো। তারা সৎ পথ ত্যাগ করে অসৎ পথে পা বাড়ালো এবং পয়গম্বরকে হত্যা করে পাপাচারে লিপ্ত হলো। পরম দয়ালু আল্লাহ আল্লাহ আবার তাদের সৎপথে আনার জন্য আর ও একজন পয়গম্বর প্রেরণ করলেন। এতে কিছু সখ্যাক জ্বীন হিদায়াত প্রাপ্ত হলেও অধিকাংশ জ্বীন পয়গম্বরের কথা না শুনে অনাচার, পাপাচারে লিপ্ত হইল এবং পয়গম্বরকে হত্যা করলো এভাবে আবুল জ্বীনের পর থেকে প্রায় ছত্রিশ হাজার বছরের মধ্যে তারা বহু সংখ্যক পয়গম্বরকে হত্যা করার পর আল্লাহ জ্বীনদের প্রতি অত্যন্ত নাখোশ হয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ ও ধ্বংস করার জন্য আসমান থেকে অসংখ্য ফেরেস্তা পাঠালেন। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতারা কোটি কোটি জ্বীনকে হত্যা করে ফেলল, শুধু কিছু ঈমানদার জ্বীন ছাড়া।
এভাবে কয়েক বার জ্বীনদের শাস্তি দিলেন আল্লাহ কিন্তু প্রতিবারই কিছু পূর্ন্যবান জ্বীন ফেরেশতাদের আক্রমন হতে রক্ষা পেল। এই পূর্ন্যবান জ্বীনদের মধ্যে চালপালিশ নামে একজন শিক্ষিত ও সর্বাপেক্ষা ধার্মিক জ্বীন ছিলো। আল্লাহ তাকে এবার জ্বিনদের বাদশা বা ধর্মীয় নেতা নিযুক্ত করে দিলেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই চালপালিশ ইবাদত বান্দেগী, আল্লাহর সুনাম অর্জন করলো এবং নিজেও ধর্ম পথে অটল রইল। কিন্তু কিছু দিন অতিবাহিত হলে দুষ্ট জ্বীনরা পথ ভ্রষ্ট হয়ে পড়লো, তাদের দেখা দেখি চালপালিশ স্বয়ং নিজেও নীতি ভ্রষ্ট হয়ে অবাঞ্চিত কাজসমূহ শুরু করে দিল। তখন আল্লাহ স্বীয় কৃপায় হযরত জিব্রাইল (আঃ) কে পাঠিয়ে চালপালিশকে সর্তক করে দিলেন। এতে তার চেতনার উদয় হলো এবং পুনরায় সৎ পথে প্রত্যাবর্তন করে নিজ ও জাতির কল্যাণকর কাজে আত্ননিয়োগ করল। কিন্তু দুষ্ট জ্বীনদের প্ররোচনায় অচিরেই চালপালিশের পয়গম্বরীর এক জাহার বছর পূর্ণ হয়ে গেল। তখন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতার মাধ্যমে চালপালিশসহ জ্বীন জাতিকে ধ্বংস করে দিলেন। এবার ও আল্লাহর কুদরতে ধ্বংসের হাত থেকে কিছু জ্বীন রক্ষা পেল।
কালক্রমে আবার জ্বীন জাতি দুনিয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। এবার আল্লাহ বিলীকা নামক জনৈক জ্বীনকে নির্বাচন করে জ্বীনদের উপর বাদশাহী ও হিদায়তের জন্য কাজ করার জন্য মনোনীত করলেন। বিরীকা পর হামুস নামক জনৈক জ্বীনকে নবুয়তের দায়িত্ব দিলেন, কিন্তু কিছুদিন ভালোভাবে জীবন যাপন করার পর পুনরায় তারা আল্লাহর নাফরমানীতে নিমজ্জিত হয়। এসময় জ্বীন জাতির আদি পিতা তারাননুসের জন্মের পর থেকে জ্বীন জাতির বয়স একলক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আল্লাহ জ্বীনদের অবস্থা দেখে নাখোশ হয়ে ফেরেশতাদেরকে হুকুম করলেন, তোমরা এবার সমস্ত জ্বীনজগত ধ্বংস করে দাও যেন, একটি জ্বীনও রক্ষা না পায়। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে ফেরেশতারা জ্বীন জাতিকে ধ্বংস করে দিতে দুনিয়াতে অবর্তীন হলেন। জ্বীনেরাও ফেরেশতাদের বাধা দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু আল্লাহর প্রেরিত ফেরেশতারা আল্লাহর শক্তিতে শক্তিমান তাদের সাথে সামান্য শক্তির জ্বীনদের প্রশ্নই উঠে না। ফেরেশতাদের আগাতে আগাতে সমস্ত জ্বীনকুল ধ্বংস হয়ে গেল। মাত্র দু, চার জন জ্বীন পাহাড়ে পর্বতে আশ্রয় নিয়ে আত্নরক্ষা করল। অবশ্যই এটা আল্লাহ রাব্বুল আলামনের হেকমত। এভাবে মহান রাব্বুল আলামীন জ্বীন জাতিকে সৃষ্টি ও তাদের কর্মফলের জন্য বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন নিপিড়ন ও শাস্তি দিয়ে আসছিল। তবুও মহান রাব্বুল আলামীন জ্বীন জাতিকে এই পৃথিবীতে বাঁচিয়ে রাখলেন আপন করুনায়। তবে এই জ্বীন জাতি অসাধারণ ভাবে মানুষের যেমন ভাল করতে পারে আবার ক্ষতিও করতে পারে। আমরা এই বিতাড়ীত শয়তান জ্বীন জাতির অনিষ্ট থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন